Pages

সিয়ামের সুন্নাত আদব

 সিয়াম পালনের কিছু মুস্তাহাব বা সুন্নাত আদব আছে যেগুলো পালন করলে সাওয়াব বেড়ে যাবে। আর তা ছেড়ে দিলে রোযা ভঙ্গ হবে না বা গোনাহও হবে না। তবে পুণ্যে ঘাটতি হবে। কিন্তু তা আদায় করলে সওয়াবের পরিপূর্ণতা আসে। নিম্নে এসব আদব উল্লেখ করা হল :

[১] সাহরী খাওয়া।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً
(ক) তোমরা সাহরী খাও, কারণ সাহরীতে বরকত রয়েছে। (বুখারী : ১৯২৩; মুসলিম : ১০৯৫)
مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ
(খ) আমাদের (মুসলিমদের) ও ইয়াহূদী-নাসারাদের সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া। (মুসলিম : ১০৯৬)
অর্থাৎ আমরা সিয়াম পালন করি সাহরী খেয়ে, আর ইয়াহূদী-নাসারারা রোযা রাখে সাহরী না খেয়ে।
نِعْمَ سَحُورُ الْمُؤْمِنِ التَّمْرُ
(গ) মু’মিনের সাহরীতে উত্তম খাবার হল খেজুর। (আবূ দাঊদ : ২৩৪৫)
السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلاَ تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ
(ঘ) (রোযাদারদের জন্য) সাহরী হল একটি বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিও না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন। (আহামদ : ১০৭০২)
[২] সাহরী দেরী করে খাওয়া।
অর্থাৎ তা শেষ ওয়াক্তে খাওয়া উত্তম। রাতের শেষাংশে গ্রহণকৃত খাবারকে সাহরী বলা হয়।
[৩] সাহরীর সময়কে ইবাদতে কাজে লাগানো। প্রতিরাতের শেষ তৃতীয়াংশ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরশ থেকে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। আর বান্দাদেরকে এই বলে আহবান করেন :
مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ وَمَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ
‘‘এখন যে ব্যক্তি আমার কাছে দু‘আ করবে আমি তা কবূল করব, যা কিছু আমার কাছে এখন চাইবে আমি তাকে তা দিব এবং যে আমার কাছে এখন মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দিব। (বুখারী : ৬৩২১; মুসলিম : ৭৫৮)
অতএব তখন কুরআন অধ্যয়ন, তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের সালাত আদায়, তাওবাহ-ইস্তিগফার ও দু‘আ কবূলের জন্য এটা এক উত্তম সময়। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন :
﴿ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨ ﴾ [الذاريات: ١٨]
‘‘তারা শেষ রাতে জেগে উঠে তাওবাহ-ইস্তিগফার করে।’’ (সূরাহ যারিয়াত-১৮)
[৪] সূর্য অস্ত যাওয়ামাত্র ইফতার করা অর্থাৎ তাড়াতাড়ি ইফতার করা। অতিরঞ্জিত সাবধানতার নামে ইফতার বিলম্ব না করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ
(ক) অর্থাৎ মানুষ যতদিন পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে। (বুখারী : ১৯৫৭; মুসলিম : ১০৯৮)
لاَ يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لِأَنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُونَ
(খ) যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন দীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে। কেননা, ইয়াহূদী ও নাসারাদের অভ্যাস হল ইফাতর দেরীতে করা। (আবূ দাঊদ : ২৩৫৩)
ثَلاَثَةُ مِنْ أَخْلاَقِ النَّبُوَّةِ : تَعْجِيْلُ الإِفْطَارِ وَتَأْخِيْرُ السَّحُوْرِ وَوَضْعِ الْيَمِيْنِ عَلَى الشِّمِالِ فِي الصَّلاَةِ
(গ) তিনটি বিষয় নাবী চরিত্রের অংশ : সময় হওয়ামাত্র ইফতার করে ফেলা, সাহরী শেষ ওয়াক্তে খাওয়া এবং সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ১০৫)
كَانَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ -صلى الله عليه وسلم- أَسْرَعُ النَّاسَ إِفْطَارًا وَأَبْطَأُهُمْ سُحُوْرًا
(ঘ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ সকলের আগে তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন এবং সকলের চেয়ে দেরীতে সাহরী খেতেন। (মুসান্নাফ আঃ রাযযাক : ৭৫৯১)
[৬] মাগরিবের সালাতের পূর্বে ইফতার করা এবং খেজুর বা পানি দ্বারা ইফতার করা।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- يُفْطِرُ عَلَى رُطَبَاتٍ قَبْلَ أَن يُّصَلِّيَ...
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মাগরিবের) সালাতের পুর্বে তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর পাওয়া না যেত তবে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। আর যদি শুকনা খেজুর পাওয়া না যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন। (আহমাদ : ৩/১৬৪)
তবে পেট ভর্তি করে খাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
مَا مَلأُ ابْنُ آدَمَ وِعَاءُ بَطْنِهِ
‘‘যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খানা খায় তার ঐ পেট (আল্লাহর কাছে) একটি নিকৃষ্ট পাত্র।’’ (তিরমিযী : ২৩৮০)
সুন্নাত হল পেটের তিন ভাগের একভাগ খাবার খাবে, আর তিনভাগের একভাগ পানি পান করবে। বাকী এক তৃতীয়াংশ শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য খালী রেখে দিবে। (তিরমিযী : ২৩৮০)
[৫] ইফতারের সময় দু‘আ করা
এ মুহূর্তটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়ার সময়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ للهِ تَعَالَى عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ كُلّ لَيْلَةٍ لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةً مُسْتَجَابَةً
(ক) ইফতারের সময় আল্লাহ রববুল ‘আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এ মুক্তি দানের পালা রমাযানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে। সে সময় সিয়াম পালনকারী প্রত্যেক বান্দার দু‘আ কবূল হয়।’’ (আহমাদ : ৭৪৫০)
(খ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন :
اَللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ
হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।
উল্লেখ্য যে, আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী উপরোক্ত হাদীসটিকে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
(ঙ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় নিম্নের এ দুআটি পাঠ করতেন :
ذَهَبَ الظَّمَاءُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ
অর্থ : ‘‘পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হল।’’ (আবূ দাউদ : ২৩৫৭, দারাকুতনী : ২২৭৯ আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)
ইফতারের সময় যখন আযান হয় তখন আযানের পরের সময়টা দু‘আ কবূলের সময়। হাদীসে আছে আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দু‘আ কবূল হয়।
[৬] বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা, সালাত আদায়, যিকর ও দু‘আ করা।
রমযান যেহেতু কুরআন নাযিলের মাস সেহেতু এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন অন্য সময়ের চেয়ে বেশি করা উচিত।
রাসূলুল্লাহ বলেছেন,
الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ
সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন (আল্লাহর কাছে) মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে, হে রব! দিনের বেলায় আমি তাকে পানাহার ও যৌন উপভোগ থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর।
কুরআনও বলবে, হে রব! (রাতে কুরআন পাঠের কারণে) রাতের নিদ্রা থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই এ পাঠকের ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ মঞ্জুর কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়েরই সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (আহমাদ : ৬৫৮৯)
[৭] ইবাদতের তাওফীক কামনা ও আল্লাহর দয়া অনুধাবন করা
আমরা যে ইবাদত করি তাও আল্লাহর দয়া। তিনি যে এ কাজে আমাদেরকে তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য আমরা তার শুকরিয়া আদায় করি। অনেকের ভাল কাজও আবার কবূল হয় না। আল্লাহ বলেন :
﴿ ...إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡمُتَّقِينَ ٢٧ ﴾ [المائدة: ٢٧]
‘‘কেবলমাত্র মুত্তাকীদের কাজই আল্লাহ কবূল করেন। (মায়িদাহ : ২৭)
ভয় ও আশা নিয়ে যেন আমরা ইবাদত করি। গর্ব-অহঙ্কার ও হিংসা বান্দার ইবাদতকে নষ্ট করে দেয় এবং কুফরী ও শির্ক করলে তার কোন নেকই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং ইবাদতসমূহ ধ্বংস ও বাতিল হয়ে যায়।
[৮] ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা।
তাদেরকে যাকাত, ফিত্‌রা ও সাদাকাহ দেয়া। হাদীসে এসেছে :
كَانَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُونُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাযানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত। (মুসলিম : ২৩০৮)
[৯] উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা।
রমযান ধৈর্যধারনের মাস। আর সিয়াম হল এ কার্য প্রশিক্ষণের ইনিষ্টিটিউট। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ
‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে, সে যেন তখন অশ্লীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেন বলে, ‘‘আমি রোযাদার’’। (মুসলিম : ১১৫১)
[১০] অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকা।
খাওয়া দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আরাম আয়েশে অনেকেই অপচয় ও অপব্যয় করে থাকে। এটা এক গর্হিত কাজ। এ থেকে বিরত থাকা।
[১১] রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগানো।
অহেতুক কথাবার্তা, আড্ডা বাজি, গল্প-গুজব, বেহুদা তর্কবিতর্ক পরিহার করা। রুটিন করে পরিকল্পনা ভিত্তিক কাজ করা। এতে জীবন অধিকতর ফলপ্রসূ হবে।
[১২] দুনিয়াবী ব্যস্ততা কমিয়ে দেয়া।
রমাযানের এ বরকতময় মাসে অর্থ উপার্জন ও ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে আখিরাতের মুনাফা অর্জনের জন্য অধিকতর বেশি সময় দেয়া আবশ্যক। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ ١٧ ﴾ [الاعلا: ١٧]
‘‘আর আখিরাতের জীবন সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী।’’ (সূরা আ‘লা : ১৭)
[১৩] খাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য রক্ষা করা।
কেউ কেউ এতো বেশি খাবার খায় যে নাস্তা ও দুপুরের খাবার শুধু ইফাতের এক বেলায়ই তা পুষিয়ে নেয়। আবার তারাবীহ ও সেহরীর ওয়াক্তের দ্বিগুণ দিনের বেলায় ঘুমিয়ে তা কাযা করে। এভাবে চললে খাবার ও ঘুমের কুরবানী হলো কীভাবে? তাই এ বিষয়ে রোযাদারকে ত্যাগ তীতিক্ষা করতে হবে এবং এ দু’এর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সিয়াম পালন করে যেতে হবে।
[১৪] ফজর উদয় হওয়ার পূর্বেই রোযার নিয়ত করা।
[১৫] আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা।
রমাযানের পবিত্র দিন ও রাতগুলোতে ইবাদত করার তাওফীক দেয়ায় মাবুদের প্রশংসা করা।

প্রথাগত অনুষ্ঠান

১. রামাদানকে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠান
মনে করাঃ
আমাদের অনেকের কাছে রামাদান তাঁর
আধ্যাত্মিকতা হারিয়ে ইবাদাতের
বদলে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠানের রূপ
লাভ করেছে। আমরা সকাল
থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ‘zombie’র মত
উপোস থাকি শুধুমাত্র আমাদের
আশেপাশের সবাই রোজা রাখে বলে।
আমরা ভুলে যাই যে এই সময়টা আমাদের
অন্তর ও আত্মাকে সকল প্রকার খারাপ
কাজ থেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য….
আমরা দু’আ করতে ভুলে যাই, ভুলে যাই
আল্লাহর
কাছে ক্ষমা চাইতে এবং জাহান্নামের
আগুন থেকে আমাদেরকে মুক্তি দান
করতে। নিশ্চিতভাবে আমরা পানাহার
থেকে বিরত থাকি কিন্তু সেটা কেবল
লৌকিকভাবেই!
যদিও আল্লাহর রাসূল (সাঃ)
বলেছেনঃ “জিবরাঈল (আঃ)
আমাকে বলেছেন, আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির
নাক মাটিতে ঘষুন যার নিকট রামাদান
আসল এবং তার গুনাহসমূহ মাফ হল না,
এবং আমি বললাম, আমিন। তারপর
তিনি বললেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির নাকও
মাটিতে ঘষুন যে জীবদ্দশায় তার
পিতামাতার
একজনকে অথবা উভয়কে বৃদ্ধ হতে দেখল
এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করার অধিকার
রাখল না তাদের সেবা করার মাধ্যমে আর
আমি বললাম, আমিন।
অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহ্ ঐ
ব্যক্তির নাক মাটিতে ঘষুন যার
উপস্থিতিতে যখন আপনার নাম উচ্চারণ
করা হয় তখন সে আপনার প্রতি সালাম
বর্ষণ করে না আর আমি বললাম,
আমিন।”(তিরমিযী, আহমাদ,
এবং অন্যান্য_আলবানী কর্তৃক
সহীহকৃত)
২. পানাহারের ব্যাপারে অতিমাত্রায়
চাপে থাকাঃ
আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে, রামাদান
মাসের পুরোটাই খাবার ঘিরে আবর্তিত
হয়। সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ও
অন্যান্য ইবাদাতের ব্যাপারে যত্নশীল
হওয়া বদলে আমরা পুরোটা দিন কেবল
পরিকল্পনা প্রণয়ন, রান্নাবান্না,
কেনাকাটা এবং খাওয়া-
দাওয়া নিয়ে চিন্তা করে কাটাই। আমাদের
চিন্তা ভাবনার পুরোটা জুড়েই
থাকে ‘খাওয়া-দাওয়া’।
যার দরূন আমরা উপোস থাকার
মাসকে ভোজের মাসে পরিণত করেছি।
ইফতারের সময়ে আমাদের টেবিলের
অবস্থা দেখার মত! পুঞ্জীভূত
নানাপদী খাবার, মিষ্টান্ন
এবং পানীয়ে পরিপূর্ণ। পক্ষান্তরে,
আমরা রামাদানের মুখ্য উদ্দেশ্য
ভুলে যাচ্ছি, আর এভাবে আমাদের লোভ
আর প্রবৃত্তির অনুসরণ
বাড়তে থাকে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার
শিক্ষালাভ করার বদলে। এটাও একধরনের
অপচয় এবং সীমালঙ্ঘন।
“…..তোমরা খাও এবং পান করো,
এবং কোনো অবস্থাতেই অপচয়
করো না, আল্লাহ্ তাআলা কখনোই
অপচয়কারীদের পছন্দ করেন
না ।”(সূরা আ’রাফঃ৩১)
৩. সারা দিন রান্না করে কাটানোঃ
কতিপয় বোন(হয় স্বেচ্ছায়
নতুবা স্বামীর চাপে) সারা দিন ও
সারা রাত ধরে রান্নাবান্না করতে থাকেন,
তার ফলে দিনের শেষে তারা এতটাই
ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে এশার সালাত
পড়তে পারেন না, তাহাজ্জুদ
কিংবা কুরআন তিলাওয়াত তো দূরে থাক!
এই মাস হল মাগফিরাত
এবং মুক্তিপ্রাপ্তির মাস। সুতরাং, চলুন
আমরা চুলা বন্ধ করে নিজেদের ঈমানের
প্রতি মনযোগী হই।
৪. মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়াঃ
আমাদের কিছুসংখ্যক সেহরীর
সময়ে নিজেদেরকে বিস্ফোরিত হওয়ার
আগ পর্যন্ত ভরাক্রান্ত করে তুলি,
কারণ আমরা মনে করি সারা দিন
ক্ষুধার্ত অনুভব না করার এটাই একমাত্র
পথ, আর কিছুসংখ্যক রয়েছেন
যারা ইফতারের সময় এমনভাবে খান
যাতে মনে হয় আগামীকাল বলে কিছুই
নেই, সারাদিন না খাওয়ার অভাব
একবারেই মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
যাহোক, এটা সম্পূর্ণরূপে সুন্নাহ্
বিরোধী কাজ।
পরিমিতিবোধ সব কিছুর চাবিকাঠি।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আদম সন্তান
তার উদর ব্যতীত আর কোনো পাত্রই
এত খারাপভাবে পূর্ণ করে না, আদম
সন্তানের পৃষ্ঠদেশ সোজা রাখার জন্য
এক মুঠো খাবারই যথেষ্ট।
যদি তোমাদেরকে উদর পূর্ণ করতেই হয়,
এক তৃতীয়াংশ খাবার দ্বারা, এক
তৃতীয়াংশ পানি দ্বারা আর অবশিষ্ট এক
তৃতীয়াংশ বায়ু দ্বারা পূর্ণ
করো।”(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্,
আলবানী কর্তৃক সহীহ্কৃত)
অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ একজন
মানুষকে আবশ্যকীয় অনেক আমল
এবং ইবাদাত হতে দূরে সরিয়ে নেয়,
তাকে অলস
করে তোলে এবং অন্তরকে বধির
করে ফেলে।
ইমাম আহমদকে একবার জিজ্ঞেস
করা হয়েছিলঃ “উদরপূর্ণ অবস্থায়
একজন মানুষ কি তার হৃদয়ে কোমলতা ও
বিনয় অনুভব করে?”
তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “আমার
মনে হয় না।”
৫. সারা দিন ঘুমিয়ে কাটানোঃ
রামাদান মাস হচ্ছে অত্যন্ত মূল্যবান
সময়, এতটাই মূল্যবান যে মহান আল্লাহ্
পাক একে ‘আইয়্যামুম
মাদুদাত’(একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক দিবস)
হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের
অনুধাবন করার পূর্বেই এই মাগফিরাত ও
মুক্তির মাস শেষ হয়ে যাবে।
আমাদেরকে চেষ্টা করা উচিত এই পবিত্র
মাসের প্রতিটি মূহুর্ত আল্লাহর
ইবাদাতে কাটানোর,
যাতে করে আমরা এই মাসের সর্বোচ্চ
সওয়াব হাসিল করতে পারি। যাহোক,
আমাদের কিছুসংখ্যক রামাদানের
দিনগুলি ভিডিও গেমস্ খেলে অতিবাহিত
করে, অথবা জঘন্যতম হল টিভি দেখা,
ছবি দেখা এমনকি গান শোনা পর্যন্ত।
সুবহানাল্লাহ্!!! আল্লাহকে মান্য করার
চেষ্টা করা হয় তাঁকে অমান্য করার
মাধ্যমে!
৬. রোজা রাখা অথচ খারাপ কাজ বর্জন
না করাঃ
আমাদের কিছু সংখ্যক
রোজা রাখে কিন্তু তারা মিথ্যাচার,
অভিশাপপ্রদান, মারামারি, গীবত
ইত্যাদি বর্জন করে না এবং কিছুসংখ্যক
রোজা রাখার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র
পানাহার থেকে বিরত নয় বরং আল্লাহর
প্রতি তাকওয়া(পরহেজগারী) অর্জন
অনুধাবন না করে রোজা রাখে কিন্তু
তারা প্রতারণা, চুরি, হারাম
চুক্তি সম্পাদন, লটারির টিকেট ক্রয়, মদ
বিক্রি, যিনা ইত্যাদিসহ যাবতীয়
অননুমোদিত কর্মকান্ড বর্জন করে না।
“হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো!
তোমাদের ওপর সাওম ফরজ
করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছিলো তোমা
দের পূর্বপুরূষদের ওপর
যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন
করতে পারো।”(সূরা বাকারাঃ১৮৩)
রাসূল (সাঃ)
বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও
এর ওপর আমল করা বর্জন করে না ও
মূর্খতা পরিহার করে না, তার পানাহার
হতে বিরত থেকে উপবাস করা আল্লাহর
নিকট প্রয়োজন নেই।”(বুখারী)
৭. ধূমপানঃ
ধূমপান ইসলামে বর্জনীয় সেটা রামাদান
মাসেই হোক বা এর বাইরে হোক, কারণ
এটা “আল-খাবিছ্’(খারাপ কাজ) এর
একটি। এবং এটা যাবতীয় ধূমপানের
সামগ্রী অন্তভূর্ক্ত করে যেমনঃ সিগার,
সিগারেট, পাইপ, শিশা, হুক্কা ইত্যাদি।
“……….তাদের জন্য যাবতীয় পাক
জিনিসকে হালাল ও নাপাক
জিনিসসমূহকে তাদের ওপর হারাম
ঘোষণা করে………..”(সূরাআ’রাফঃ১৫৭)
এটা শুধু যে ধূমপায়ী তার জন্য ক্ষতিকর-
তা নয়, বরং তার
আশেপাশে যারা রয়েছে তাদের জন্যও
ক্ষতিকর। এটা কারো অর্থ অপচয়ের
জন্য একটি মাধ্যমও বটে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “কোনো ধরনের
ক্ষতিসাধন
করা যাবে না কিংবা ক্ষতিসাধন বিনিময়ও
করা যাবে না।”
এই হাদীস বিশেষত রামাদানের
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
এবং এটা সাওমকে বাতিল করে দেয়।
(ফতওয়া-ইবনে উছাইমিন)
বিস্তারিত জানতে ভিডিওটি দেখুন
৮. ইচ্ছাকৃতভাবে সেহরী বাদ দেওয়াঃ
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সেহরী খাও,
কারণ এটার মধ্যে বরকত রয়েছে।”(বুখারী,
মুসলিম)
এবং তিনি (সাঃ) বলেছেনঃ “আমাদের
সাওম আর আহলে কিতাবদের সাওম
পালনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য
হচ্ছে সেহরী গ্রহণ।”(মুসলিম)
৯. ইমসাক এর সময় সেহরী খাওয়া বন্ধ
করে দেওয়াঃ
কিছু লোক রয়েছে যারা ফজরের
ওয়াক্তের ১০-১৫ মিনিট পূর্বে ইমসাক
পালনের জন্য সেহরী খাওয়া বন্ধ
করে দেয়। শেখ ইবনে উছাইমিন
বলেছেনঃ “এটা বিদ’আত ছাড়া আর কিছু
নয় যার কোন ভিত্তি সুন্নাহে নেই।
বরং সুন্নাহ হল তার উল্টোটা করা।
আল্লাহ প্রত্যুষের আগ পর্যন্ত
আমাদেরকে খেতে অনুমতি প্রদান
করেছেনঃ “আর আহার কর ও পান কর
যতক্ষণ না ফজরের
সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্ট
হয়।”(সূরা বাকারাঃ১৮৭)
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আহার
কর ও পান কর যতক্ষণ
না ইবনে উম্মে মাকতুম এর আযানের
ধ্বনি শুনতে পাও, কারণ সে প্রত্যূষ
না আসা পর্যন্ত আযান দেয় না।”
এই ইমসাক হচ্ছে কিছু সংখ্যক লোকের
দ্বারা পালনকৃত আল্লাহর আদেশের
অতিরিক্ত কাজ, তাই এটা ভুয়া।
এটা ধর্মের নামে এক ধরনের
উগ্রপন্থী আচরণ। আর রাসূল (সাঃ)
বলেছেনঃ “যারা উগ্রপন্থা অবলম্বন
করে তারা ধ্বংস হয়েছে,
যারা উগ্রপন্থা অবলম্বন
করে তারা ধ্বংস হয়েছে,
যারা উগ্রপন্থা অবলম্বন
করে তারা ধ্বংস হয়েছে।”(মুসলিম)
১০. সেহরী না খাওয়ায় সাওম পালন
না করাঃ
আমাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক
রয়েছে যারা সাওম পালন করে না এই
ভয়ে যে সেহরী খাওয়া হয় নি।যাহোক,
এটা এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য
ভালোবাসা ও কাপুরূষতা। এ আর এমন
কি ব্যাপার যে সামান্য কয়েক
মুঠো খাবার খাওয়া বাদ হয়ে যায়? এমন
না যে এর কারণে আমরা মারা যাব।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর
প্রতি আনুগত্য সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায়।
১১. ইফতার এবং সেহরির নিয়ত করা
ইফতার এবং সেহরির সময় নিয়ত এর
উদ্দ্যেশ্যে মুখ দিয়েদুআউচ্চারণ
করা শরীয়ত সম্মত নয়। ইফতার
এবং সেহরির যে সকল দুআ আমাদের
দেশে প্রতি বছর ইসলামিক
ক্যালেন্ডারগুলিতে প্রকাশিত হয়
সেগুলো বিদআত। ইফতার
অথবা সেহরির জন্য নির্দিষ্ট কোন দুআ
সহিহ হাদিস এ নেই। এক্ষেত্রে শুধু
মনে মনে নিয়ত করলেই ইনশাআল্লাহ
হবে।
১২. রোযা ভাঙতে দেরি করাঃ
আমাদের অনেকেই ইফতারের সময়
মাগরিবের আযান শেষ হওয়া পর্যন্ত
বসে থাকেন, আযান শেষ
হলে রোযা ভাঙেন। সূর্য অস্ত যাবার
পর আযান দেওয়ার
সাথে সাথে রোযা ভাঙা সুন্নাহ সম্মত।
আনাস(রাঃ) বলেন,“রাসুলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
এটাই করতেন।(মুসলিম)
১৩. ইফতার বেশি খেতে গিয়ে মাগরিবের
নামায জামাআত ধরতে না পারাঃ
আমরা অনেকেই ইফতারিতে এত
বেশি খাবার নিয়ে বসি যে সেগুলো শেষ
করতে গিয়ে মাগরিবের জামাআত
ধরতে পারিনা। এটা একেবারেই অনুচিত।
রাসুল(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কয়েক
টুকরা খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার
ভেঙে অতঃপর মাগরিবের নামাজ এর
জন্য চলে যেতেন। নামাজ শেষ
করে এসে আমরা ফিরে এসে ইচ্ছা করলে আ
রও কিছু খেতে পারি।
১৪. আমাদের দুআ কবুল হওয়ার সুযোগ
ছেড়ে দেওয়াঃ
সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির দুআ
রোযা ভাঙার সময় আল্লাহর নিকট
কবুল হয়ে থাকে। রাসুল(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন,“তিন
ধরনের ব্যক্তির দুআ
ফিরিয়ে দেওয়া হয়না- ১)একজন পিতার
দুয়া, ২)রোযাদার ব্যক্তির দুয়া,
৩)মুসাফিরের নামাজ”।(বায়হাকি)
আমরা এই সময়ে দুআ না করে বরং খাবার
পরিবেশন,কথাবার্তা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত
থাকি। আমাদের চিন্তা করা উচিৎ
কোনটা আমাদের দরকার- খাবার
নাকি দুআ কবুল হওয়া ?
১৫. রোযা রাখা অথচ নামাজ না পরাঃ
সিয়াম পালনকারী কোন ব্যক্তি নামাজ
না পরলে তার সিয়াম কবুল হয়না। রাসুল
(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন,“সালাত
(নামাজ) হচ্ছে ঈমান এবং কুফর এর
পার্থক্যকারী”।(মুসলিম)
আসলে শুধু সিয়াম নয়,সালাত(নামাজ)
না পরলে কোন ইবাদতই কবুল হয়না।
রাসুল(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন,“যে আসরের
সালাত পরেনা, তার ভাল কাজসমূহ
বাতিল হয়ে যায়।”(বুখারি)
১৬. রোযা রাখা অথচ হিজাব না পরা
মুসলিম নারীদের জন্য হিজাব
না পরা কবীরা গুনাহ।
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন
তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের
যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন
যা সাধারণতঃ প্রকাশমান,
তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন
না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার
ওড়না বক্ষ
দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের
স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর
পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র,
স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী,
যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক,
যারা নারীদের গোপন অঙ্গ
সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত
কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ
না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-
সজ্জা প্রকাশ করার জন্য
জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ,
তোমরা সবাই আল্লাহর
সামনে তওবা কর,
যাতে তোমরা সফলকাম হও।”(আন-
নুরঃ ৩১)
“হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও
কন্যাগণকে এবং মুমিনদের
স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের
চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর
টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ
হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত
করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম
দয়ালু।”(আল-আহযাবঃ ৫৯)
সুতরাং রোযা রাখা অথচ হিজাব
না পরা অবশ্যই সিয়াম পালনের পুরস্কার
হতে দূরে সরিয়ে দেয় যদিও এটি সিয়াম
ভঙ্গ করেনা।
১৭. পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার জন্য
রোযা না রাখা
পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার
কারণে রোযা না রাখা শরীয়ত সম্মত
নয়। সকালে পড়ালেখা করতে কষ্ট
হলে রাতে করার সময় থাকে। আমাদের
মনে রাখা উচিৎ যে পরীক্ষায় ভাল
ফলাফল করার চেয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট
করাটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
পড়ালেখা করার মধ্যে দিয়েও
যদি আমরা সঠিকভাবে যদি আমরা রোযা রা
খার মত ফরয কাজগুলো করার
চেষ্টা করি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ
আমাদের জন্য তা সহজ করে দিবেন
এবং আমাদের সাহায্য করবেন।
“……আর যে আল্লাহকে ভয় করে,
আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ
করে দেবেন।এবং তাকে তার ধারণাতীত
জায়গা থেকে রিযিক দেবেন।
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর
ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট।
আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন।
আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ
স্থির করে রেখেছেন।”(আত-
তালাকঃ ২-৩)
১৮. স্বাস্থ্য কমানোর
উদ্দ্যেশ্যে রোযা রাখা
স্বাস্থ্য কমানোর জন্য
রোযা রাখা উচিত নয়। এটি অন্যতম
একটি বড় ভুল যা আমরা করে থাকি।
সিয়াম পালন করার একমাত্র উদ্দ্যেশ্য
হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
যদি স্বাস্থ্য কমানোর উদ্দ্যেশ্যে কেউ
রোযা রাখে তাহলে তা শিরকের(ছোট
শিরক বা শিরকুল আসগার) আকার ধারন
করতে পারে।
১৯. তারাবীর নামাযের রাকাআত
সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধঃ
তারাবীর নামাযের কোন নির্দিষ্ট
সংখ্যক রাকাআত নেই। আট এবং বিশ
রাকাআত-এ দুটোই শরীয়ত সম্মত।
শেখ ইবনে উথাইমিন
বলেন,“এগারো কিংবা তেইশ রাকাআতের
কোনটিকে নির্দিষ্ট করে অপরটি বাতিল
করা অনুচিত।কারন বিষয়টি অনেক
তাৎপর্যপূর্ণ,সমস্ত
প্রশংসা আল্লাহর।”
২০. নির্দিষ্টভাবে শুধু ২৭ রমযানের
রাতকে লাইলাতুল ক্বাদর
মনে করে ইবাদত করাঃ
আমরা অনেকেই কেবল ২৭ রমযান
রাতে লাইলাতুল ক্বাদর পাওয়ার জন্য
ইবাদত করে থাকি,কিন্তু অন্যান্য
বিজোড় রাতগুলিকে প্রাধান্য দেইনা।
অথচ রাসুল(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন,“রমযানের
শেষ দশ রাত্রির বিজোড়
রাতগুলিতে লাইলাতুল ক্বাদর তালাশ
কর।”(বুখারি ও মুসলিম)
২১. ঈদের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রমযানের
শেষাংশ অবহেলায় পালন করা
আমরা অনেকেই ঈদের প্রস্তুতি(নতুন
কাপড় কেনা,খাবারের আয়োজন
করা,মার্কেটে ঘোরাঘুরি করা)নিতে গিয়ে র
মযানের শেষ দশ দিন অবহেলায় পালন
করি(ঠিকমত ঈবাদত
না করা এবং লাইলাতুল ক্বাদরের তালাশ
না করা)। রাসুল(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)রমযানের শেষ
দশ দিন আল্লাহর ইবাদতে খুব
বেশি সময় নিমগ্ন
থাকতেন,কেনাকাটি করায় ব্যস্ত থাকতেন
না। রমযান শুরু হবার আগেই আমাদের
কেনাকাটি শেষ করা উচিৎ।
আয়শা (রাঃ)হতে বর্ণিত,“যখন রমযানের
শেষ দশক শুরু হত রাসুল(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)লুঙ্গি শক্ত
করে বাঁধতেন(অর্থাৎ ইবাদতে ব্যস্ত
থাকতেন,স্ত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ
হওয়া থেকে বিরত
থাকতেন),রাত্রি জাগরণ করতেন
এবং তাঁর
পরিবারকে জাগিয়ে তুলতেন।”(বুখারী,মুসলি
ম)
২২. ইফতার পার্টির আয়োজন করা
যদিও
অপরকে ইফতারি করানোতে সওয়াব
আছে এবং এ কাজে উৎসাহ প্রদান
করা হয়েছে, তথাপি আমাদের অনেকেই
মুখরোচক ইফতার পার্টির আয়োজন
করে থাকেন,যেখানে হিজাববিহীন
নারীদের আগমন থেকে শুরু করে অশ্লীল
নাচ-গান, নারীপুরুষের অবাধ
মেলামেশা,তারাবিহ এর নামাজ
ছেঁড়ে দেওয়া- এ সবই
হয়ে থাকে যেগুলো সম্পূর্ণভাবে ইসলামে ন
িষিদ্ধ।

“কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান
করলে যতজন তার অনুসরণ
করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের
অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ
করেছে তাদের সওয়াবে কোন
কমতি হবেনা” [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

₹₹ মাহে রামাজানের বিশটি স্পেশাল
আমল ₹₹
ভূমিকা: বছর ঘুরে আবারো রামাজান
আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে রামাজানের
রোযা ফরজ হওয়ায় আল্লাহর রাসুল ও
তার সাহাবীদের জীবনে আমাদের
মতো এত বেশি রমজানের রোযা ও
ইবাদতের সুযোগ আসে নি।কিন্তু
যে কয়টি রমজান তাঁরা পেয়েছেন, সেগুলোর
সদ্ব্যবহার করে তারা সফলকাম হয়েছেন।
তাদের মতো সফলতা পেতে এবং রমজান ও
সিয়াম সাধনাকে সার্থক
করতে হলে পরিকল্পিত প্রয়াস
চালাতে হবে।
ঈমানদারেরও আমল ও ইবাদতের মৌসুম
হলো মাহে রমজানুল মুবারক। অন্য
সময়ের ইবাদতের ঘাটতিপুশিয়ে নেওয়ার
সর্বোত্তম সময় এটি। আর সেজন্য এই
মাসে অন্য সাধারণ আমলের ধারা অব্যাহত
রাখার পাশাপাশি রমজানের বিশেষ আমল
বা কর্মসূচীগুলোর প্রতি যত্নবান
হতে হবে।
নিন্মে প্রতিটি কর্মসূচির সূত্র ও হাদীসের
ভাষ্য উল্লেখ করা হল:
১/তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখবে চাঁদ
দেখে ঈদ করবে। -বুখারী ও মুসলিম
২/তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমজান মাস
পাবে, সে যেন রোযা রাখে। -
সুরা বাক্কারা১৮৫
৩/যে ব্যক্তি রমজান
মাসে রাতে জেগে নামায আদায়
করবে আল্লাহ তার পিছনের গুনাহ মাফ
করে দিবেন। -বোখারী ও মুসলিম
৪/মানুষ কল্যাণের মধ্যে থাকবে যাবত
বিলম্ব না করে ইফতার করবে এবং শেষ
সময়ে সাহরী খাবে। -বোখারী ও মুসলিম।
৫/মানুষ কল্যাণের মধ্যে থাকবে যাবত
বিলম্ব না করে ইফতার করবে এবং শেষ
সময়ে সাহরী খাবে। -বোখারী ও মুসলিম
৬/তিন ব্যক্তির দু’আ
ফিরিয়ে দেওয়া হয়না।….রোযাদার ব্যক্তি-
ইফতারের আগ পর্যন্ত।-তিরমিযি আহমদ
ইবনে খুযাইমা ও ইবনে হিব্বান।
৭/যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও
কাজ পরিত্যাগ করলো না, তার উপবাস
থাকায় আল্লাহর কোন
প্রয়োজনীয়তা নেই। -আহমদ আবু দাউদ
তিরমিযি।
৮/কেউ তাকে (রোযাদারকে)
গালি দিলে বা ঝগড়া করলে সে যেন
বলে আমি রোযাদার।-বোখারী ও
মুসলিম।
৯/যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার
করাবে, তাকে রোযাদারের সম পরিমাণ
ছওয়াব দেওয়া হবে। তবে রোযাদারের
ছওয়াবে কোন কর্তন করা হবে না।-
তিরমিযি
১০/রমজানের প্রতি রাতে জিবরীল
আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাত করতেন
এবং তাকে কুরআনের দারস দিতেন।-
আহমদ, বোখারী।
১১/সকলের মধ্যে আল্লাহর রাসুল ছিলেন
সবচেয়ে দানশীল আর তিনি রমজানে অধিক
দানশীল হতেন যখনতার কাছে জিবরীল
আগমন করতেন।-বোখারী ও মুসলিম।
১২/আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রোযা রেখে মিসওয়াক
করতে দেখেছি। তার সংখ্যা গুনে আমি শেষ
করতে পারবোনা। -বোখারী
১৩/রমজান মাসে উমরা করা হজ্জের
সমতুল্য।–বোখারী ও মুসলিম। কোন
কোন বর্ণনায় এসেছে আমার
সাথে হজ্জের সমতুল্য।
১৪/আল্লাহর রাসুল (রমজানের) শেষ
দশকে (ইবাদতে) যে পরিমাণ পরিশ্রম
করতেন অন্য কোন সময় তা করতেন না।
শেষ দশক এলে তিনি কমর বেঁধেনিতেন,
রাত জাগতেন এবং পরিবারের লোকদের
জাগিয়ে দিতেন।–মুসলিম
১৫/আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত
রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। -
বোখারী ও মুসলিম।
১৬/তোমরা রমজানের শেষ দশকের
বেজোড় রাত সমূহেশবে কদর অন্বেষণ
করো।–বোখারী।
১৭/আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর
ধার্য করেছেন রোযাদারের অনর্থকতা ও
পাপাচার থেকে পবিত্র করার জন্য
এবং মিসকিন ব্যক্তিদের খাদ্য হিসেবে।
যে ব্যক্তি তা ঈদের নামাযের পূর্বে আদায়
করবে তা গ্রহণযোগ্য
এবং যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পরে আদায়
করবে তা সাধারণ সাদকাবলে গণ্য হবে।–
আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ।
১৮/আর (এই মাসে) অনেক
লোককে আল্লাহ তা’আলা জাহান্নাম
হতে মুক্ত করেন। আর তা প্রতি রাতে।–
সহীহ ইবনে খুযাইমাহ আহমদ ও
ইবনে মাজাহ। অন্য হাদীসে এসেছে-
আল্লাহর রাসুল বলেছেন,
যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ তার গুনাহ
মাপ হয়নি, অত:পর জাহান্নামে প্রবেশ
করলো…। ইবনে হিব্বান ইবনে খুজাইমাহ
বাইহাকী ও সহীহুত তারগীব ওয়াত
তারহীব।
১৯/রমজানের প্রথম রাতে একজন ঘোষক
ঘোষণা দেয়, হে সৎ কর্মেচ্ছুক, অগ্রসর
হও, হে মন্দ কর্মেচ্ছুক, বিরত থাক। -
তিরমিযি ইবনে মাজাহ।
২০/তোমাদের উপর রোযা ফরজ
করা হয়েছে যেমন ফরজ
করা হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর।
যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।
-বাকারা ১৮৩
লেখক: শাইখ আহমাদুল্লাহ, দাঈ, পশ্চিম
দাম্মাম, ইসলামিক সেন্টার সৌদী আরব।
সম্পাদনায়: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী,
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স
সেন্টার, সৌদী আরব।

No comments:

Post a Comment

কুরআনের কিছু আয়াত

 কুরআনের কিছু আয়াত এখানে এমন কিছু কুর'আনের আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো আমাদের অন্তরকে শীতল করবে এবং পরকালীন প্রস্তুতি নিতে সাহায্য ক...