তোমার রবের পক্ষ থেকে পুরস্কার, এক যথার্থ উপহার —আন-নাবা
নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রতি সদাসতর্কদের জন্যই রয়েছে চূড়ান্ত সফলতা— বাগানের পর বাগান, আঙ্গুরের সমাহার, আকর্ষণীয় মানানসই জুটি, উপচে পড়া পানপাত্র। সেখানে তারা কোনো ধরনের ফালতু কথা বা মিথ্যা কথা শুনবে না —তোমার রবের পক্ষ থেকে পুরস্কার, এক যথার্থ উপহার। —আন-নাবা ৩১-৩৬
নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রতি সদাসতর্কদের জন্যই রয়েছে চূড়ান্ত সফলতা
আল্লাহ تعالى আছেন এবং তিনি আমাদের সব কাজ দেখছেন, সব কথা শুনছেন এবং সব চিন্তা বুঝতে পারছেন —এই ব্যাপারে যারা সদা-সতর্ক থাকে এবং তাঁর ভয়ে নিজের কথা-কাজ-চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই হচ্ছেন মুত্তাকী অর্থাৎ তাকওয়াবান। শুধুমাত্র তাকওয়াবানদেরকে আল্লাহ تعالى নিশ্চয়তা দিয়েছেন চূড়ান্ত সফলতার।
কেন তাকওয়া এত গুরুত্বপূর্ণ? শুধু নামাজ, রোজা, হাজ্জ করলেই কি যথেষ্ট নয়?
তাকওয়া নেই এমন পাঁচ-ওয়াক্ত-নামাজী বাসায় এসে পরিবারের সাথে, কাজের লোকের সাথে, এমনকি নিজের সন্তানের সাথে দানবের মত আচরণ করে। তাকওয়া নেই এমন হাজ্জি ঘুষ খেয়ে হজ্জে যায় এবং হজ্জ থেকে ফিরে এসে আবার ঘুষ খায়। তাকওয়া নেই এমন দাড়িওয়ালা পণ্যে ভেজাল দেয়, কমদামী মাল বেশী দামে চালিয়ে দেয়, কাগজপত্রে মিথ্যা কথা লিখে অন্যায় সুবিধা নেয়, অফিসে লুকিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করে, নামাজ পড়তে বের হয়ে আর সহজে কাজে ফেরত আসে না ইত্যাদি। —ধর্মীয় বেশভূষাধারী এই মানুষগুলোর স্বভাব এবং কাজের জন্য ইসলামের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়, কারণ এদেরকে দেখে অন্যেরা মনে করে যে, এটাই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের শিক্ষা। ইসলামের সবচেয়ে বড় ক্ষতি তখন এরাই করে।
তাকওয়া হচ্ছে সবসময় সতর্ক থাকা যে, একজন প্রচণ্ড ক্ষমতাধর সত্ত্বা সবসময় আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। একইসাথে তিনি দুজন অদৃশ্য সত্তাকে আদেশ করেছেন প্রতি মুহুর্তে আপনার গতিবিধি নজর রাখার জন্য। এই পুরো মহাবিশ্ব তাঁর হাতের মুঠোয়। আপনি তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যও ফাঁকি দিতে পারবেন—এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। —এই উপলব্ধি থেকে যারা নিজেদেরকে দুনিয়ার প্রলোভন থেকে বাঁচিয়ে চলেন এবং ‘লোকে কী বলবে’-কে ভয় না পেয়ে বরং ‘আমার প্রভু কী বলবেন’-কে বেশি ভয় পান — তারাই তাকওয়াবান, তারাই মুত্তাকী।
যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ উপলব্ধি করছে না যে, একদিন তাকে আল্লাহর تعالى সামনে দাঁড়িয়ে সব কাজের জবাব দিতে হবে— ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ধর্ম শিখিয়ে বেশি লাভ হবে না। ধর্ম তার কাছে শুধুই কিছু তত্ত্ব কথা হয়ে থাকবে। ধর্মীয় নিয়মকানুনগুলো মানার জন্য সে কোনো আগ্রহ খুঁজে পাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য মানুষ তাকে দেখতে পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকবে। তারপর একা হলেই তার আসল চেহারা বের হয়ে যাবে। দেশের আইন-কানুন তাকে হয়তো সমাজে, ঘরের বাইরে অন্যায় করা থেকে দূরে রাখতে পারবে। কিন্তু কোনো নির্জন রাস্তায়, অন্ধকার পার্কে, নিজের ঘরের ভেতর, নিজের পরিবারের সাথে, নিজের সাথে জঘন্য কাজ করা থেকে তাকে আটকাতে পারবে না। এর জন্য একমাত্র সমাধান হচ্ছে তাকওয়া এবং বিশেষ করে কিয়ামতের বিচারের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস।
যারা আল্লাহর تعالى প্রতি সাবধান থেকে নিজেদেরকে পাপ থেকে দূরে রাখবেন এবং তাঁর আনুগত্য করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, তাদের জন্যই রয়েছে অন্তিম সফলতা। সেই সফলতার কিছু চিত্র আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিয়েছেন—
বাগানের পর বাগান, আঙ্গুরের সমাহার, … উপচে পড়া পানপাত্র।
জান্নাতে থাকবে حدائق হাদাইক অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তিগত বাগান। চারদিকে সারি সারি খেজুর গাছের মনোহর সীমানার ভেতরে থোকা-থোকা মিষ্টি আঙ্গুরের বাগান, অপূর্ব ফুলের সমাহার। এরকম একটা দুটো নয়, অগণিত ব্যক্তিগত বাগানের মালিক হবে প্রতিটি জান্নাতি। সেই বাগান ভর্তি থাকবে রকমারি ফলের সমাহার। এমন সুস্বাদু ফল, যার স্বাদ আমরা এখন কল্পনাও করতে পারবো না। সেখানে থাকবে না ফরমালিন এবং কার্বাইডের দুশ্চিন্তা। থাকবে না কোনো ভেজাল খাবার। নিশ্চিন্তে যত ইচ্ছা খাও। অসুস্থ হওয়ারও ভয় নেই।
জান্নাতিরা নরম গালিচায় বসে, আয়েস করে বালিশে হেলান দিয়ে, হালকা রোদে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেবে। সামনে তাকিয়ে উপভোগ করবে আল্লাহর تعالى নিজের পরিকল্পনায় তৈরি করা বিশাল বাগানের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। যতদূর চোখ যায়, অকল্পনীয় সুন্দর দৃশ্য। যতক্ষণ মন চাইবে বসে বসে দেখবে। অন্ধকার হয়ে যাওয়ার তাড়া নেই। রান্না করার তাগাদা নেই। কাজে যাওয়ার চিন্তা নেই বা পরীক্ষার পড়ার ভয় নেই। —শুধুই অফুরন্ত অবসর।
একইসাথে সামনে সারি সারি দামি পান-পাত্রে রাখা থাকবে অমৃত সুধা। সেখান থেকে একটার পর একটা পাত্র নিয়ে চুমুক দেবে, আর তীব্র আনন্দে হারিয়ে যাবে। যত ইচ্ছা পান করবে। কোনো নিষেধ নেই। বাথরুমে যাওয়ারও দরকার নেই।
জান্নাতে এত এত আনন্দ আরও বহু গুণে বেড়ে যাবে, কারণ তার পাশে বসে থাকবে–
আকর্ষণীয় মানানসই জুটি
কিছু অনুবাদ এবং তাফসিরে كواعب أترابا — কাওয়াইবা আতরাবা অর্থ করা হয় সমবয়স্কা নব যৌবনা যুবতিরা, হুর এবং আরও কিছু অর্থ, যা পুরুষদের জন্য বড়ই আকর্ষণীয়। এগুলো পড়ে নারীদের মন খারাপ করার দরকার নেই। কারণ সেই অর্থগুলো এই আয়াতের সম্ভাব্য অর্থগুলোর একটি। কাওয়াইবা আতরাবা-এর অন্যান্য অর্থ হলো আকর্ষণীয় মানানসই জুটি, সমবয়স্ক সঙ্গী, গৌরবোজ্জ্বল সঙ্গী ইত্যাদি। যে ধরনের সঙ্গী হলে তারা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হবে এবং তাদের সঙ্গ সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যাবে, একদম সেরকম মনের মতো সঙ্গী।[১৮]
জান্নাতে সঙ্গীরা হবে সমবয়স্ক তরুণ-তরুণী। কারণ সমবয়স্ক সঙ্গীর সাথেই একান্তে থাকা যায়। মনের কথা খুলে বলা যায়। আনন্দের অভিজ্ঞতাগুলো নিঃসঙ্কোচে উপভোগ করা যায়। বয়সের পার্থক্য হলে সঙ্গ ঠিক পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না। জান্নাতে গিয়ে একজন তরুণ যদি তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে পায় অথবা একজন তরুণী যদি তার বৃদ্ধ স্বামীকে পায়, তাহলে তো আফসোস থেকে যাবে।
এখানে একটা চিন্তার ব্যাপার রয়েছে: কেন আল্লাহ تعالى জান্নাতে সঙ্গীদের ব্যাপারে এত গুরুত্ব দিয়েছেন? কু’রআনে তিনি কয়েকবার জান্নাতের সঙ্গীদের কথা বিশেষভাবে বলেছেন। নিশ্চয়ই সঙ্গী একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তা না হলে আল্লাহ تعالى জান্নাতের অসংখ্য সুখের মধ্যে থেকে সঙ্গীকে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করতেন না।।
আল্লাহ تعالى মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, একটি বয়সের পর থেকে তার মনের মধ্যে একজন সঙ্গীর জন্য একধরনের মানসিক শূন্যতা তৈরি হয়, যেটা অন্য কিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। প্রথম মানুষ আদম عليه السلام এর মধ্যেও এই শূন্যতা ছিল। তিনি জান্নাতের মতো অনন্ত সুখের জায়গায় থেকেও একা বোধ করতেন। তার এই শূন্যতা দূর করার জন্য আল্লাহ تعالى তাকে একজন সঙ্গিনী দিয়েছিলেন।
আদম عليه السلام এর পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষ এসেছে, সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক—তাদের প্রত্যেকের মনের ভেতরেই একটা বয়সের পর থেকে একজন সঙ্গীর জন্য একধরনের শূন্যতা কাজ করে। এই মানবীয় বৈশিষ্ট্যটি আল্লাহ্-ই تعالى মানুষের মাঝে দিয়ে দিয়েছেন। সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য আল্লাহ تعالى আমাদেরকে হালাল উপায়ে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছেন কিশোর বয়সে পড়ার পর থেকেই, সংসার চালানোর মতো সামর্থ্য থাকলে।
কিন্তু অনেকে সেই হালাল উপায় বেছে না নিয়ে, অনেক সময় বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, সমাজের চাপে পড়ে অনেক বয়স পর্যন্ত বিয়ে না-করে, বিভিন্ন ধরনের হারাম উপায়ে সেই শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করে। অনেকে সেটা করে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের মাধ্যমে। অনেকে করে সারাদিন রোমান্টিক মুভি, হিন্দি গানে বুঁদ হয়ে থেকে। আবার অনেকে করে সারাদিন ফেইসবুকে চ্যাট করে, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে মোবাইল হার্ড ডিস্কে করে নোংরা ভিডিও কপি করে এনে।
এগুলোর কোনোটাই তার মনের ভেতরের সেই শূন্যতাকে পূরণ করে না, শুধুই পূরণ করার একটা সাময়িক ধোঁকা দেয় এবং তার মধ্যে একধরনের মানসিক বিকৃতি তৈরি করে। এরপরে সে আর স্বাভাবিক মানুষের মতো পরিষ্কার মনে সুস্থ চিন্তা করতে পারে না। একজন স্বাভাবিক মানুষ পারিবারিক জীবনে যতটা সুখী হতে পারে, তার সঙ্গীকে যতটা উপভোগ করতে পারে, সেটা আর সে কখনো পারে না। তার বিবাহিত জীবন হয় হতাশায়, আশাভঙ্গে ভরা।
মানুষের এই মানসিক চাহিদাকে পূরণ করে, মনে স্থায়ী শান্তি পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে হালাল উপায়ে বিয়ে। কিন্তু সম্পূর্ণ ইসলাম বহির্ভূত নিয়মে, কখনো বা সংস্কৃতির নামে হারাম সব অনুষ্ঠান করে প্রচুর খরচ করে বিয়ে করে, বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা নিয়ে সংসার শুরু করে সেই শূন্যতা পুরোপুরি পূরণ করা যায় না এবং সংসারে শান্তিও আসে না। একইভাবে লিভ টুগেদার করে—যেখানে কি না আপনার সঙ্গী যেকোনো মুহূর্তে আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে—সেটাও আমাদের ভেতরের এই শূন্যতা, নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষাকে মেটাতে পারে না। এই সমস্যার একমাত্র সম্পূর্ণ সমাধান হচ্ছে আল্লাহর تعالى দেওয়া সমাধান—একজন তাকওয়াবান মানুষকে জীবন-সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়ে, মুহাম্মাদ عليه السلام দেখানো উপায়ে পরিমিত ব্যয় করে, অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান করে বিয়ে করা।
“আর তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি হল যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই সত্তা থেকে সহধর্মিণী সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা তাদের (স্ত্রী) মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা আর দয়া তৈরি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা চিন্তা করে। [আর-রুম ২১]”
জীবনটা যতই সংগ্রামের হোক না কেন, একজন তাকওয়াবান সঙ্গী/সঙ্গিনী সাথে থাকলে যে কত সহজে আল্লাহর تعالى উপর আস্থা রেখে জীবনটা পার করা যায়, নিজের ঈমানকে ধরে রাখা যায়, হাজারো কষ্টের মধ্যেও মনে শান্তি ধরে রাখা যায়—সেটা যাদের নেই, তাদেরকে বলে বোঝানো যাবে না। আসুন আমরা আমাদের জীবন সঙ্গীর সাথে আরেকটু সময় ব্যয় করি: তাকে আল্লাহর تعالى আরও কাছে নিয়ে যাবার জন্য। কারণ সে শুধু একাই যাবে না, সে আপনাকেও সাথে নিয়ে আল্লাহর تعالى কাছে যাবে এবং একদিন সে-ই আপনাকে ঈমান হারিয়ে ফেলার মতো কঠিন সব ঘটনায় শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে রাখবে, যাতে করে আপনি পথ হারিয়ে না ফেলেন। শেষ পর্যন্ত একদিন যখন অনেক সংগ্রাম করে জান্নাতে পৌঁছাবেন এবং জান্নাতের অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে হঠাৎ করে এক অপার্থিব অতুলনীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে থমকে দাঁড়াবেন, তাকিয়ে দেখবেন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আপনার সেই ভালোবাসার জীবন সঙ্গী।
সেখানে তারা কোনো ধরনের ফালতু কথা বা মিথ্যা কথা শুনবে না
জান্নাতে কেউ বাজে কথা বলে না। দুনিয়াতে থাকতে মানুষ একে অন্যের নামে বদনাম, কুটনামি করত। খেলা, রাজনীতি, তারকাদের ফালতু খবর নিয়ে দিনরাত মশগুল থাকত। ঝগড়া-বিবাদ, গলাবাজি, অন্যের কাছে নিজেকে বড় বলে জাহির করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকতো —এগুলো ছিল নিজের এবং অন্যের মানসিক অশান্তির অন্যতম কারণ। জান্নাতে এগুলোর কিছুই থাকবে না। হাজার হোক জান্নাতবাসীরা হচ্ছেন উঁচু স্ট্যান্ডার্ডের মানুষ। তারা দুনিয়াতে থাকতেই অনর্থক কথা, অশান্তির কথা বলে বেড়াতেন না। জান্নাতে তো কখনই বলবেন না। এই একটি জিনিস না থাকার কারণেই জান্নাতবাসীদের শান্তি বহুগুণে বেড়ে যাবে।
এই আয়াত থেকে আমরা একটি উপদেশ পাই। বাজে কথা থেকে দূরে থাকলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। আমরা যদি দুনিয়াতে বাজে কথা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে আমরা দুনিয়াতেই অনেক বেশি মানসিক শান্তিতে থাকবো। নিজেদের মুখকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা যেমন নিজেকে এবং অন্যেকে মানসিক শান্তি দেবো, ঠিক একইভাবে বাজে কথা, অনর্থক কথা বলে বেড়ায় এমন মানুষদের থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে দূরে রেখে নিজেদেরই মানসিক শান্তি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারব।
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, টেলিভিশন এবং সামাজিক গণমাধ্যম (যেমন ফেইসবুক) থেকে মানুষ যখন নিজেকে দূরে রাখতে পারে, তখন তার মানসিক শান্তি বহুগুনে বেড়ে যায়। এর কারণ এগুলো হচ্ছে বাজে কথার অনন্ত উৎস। কুটনামি, গালাগালি, কাঁদা ছোড়াছুড়ি, ফাঁকা গলাবাজি, ভুয়া খবর, প্রতারণা, মিথ্যা —এই সবকিছুর বাজার হচ্ছে টিভি এবং ফেইসবুক।
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের এগুলোর প্রতি ঝোঁক থাকে, কারণ এগুলো থেকে তারা একধরনের সাময়িক উত্তেজনা পায়। ঠিক যে ধরনের উত্তেজনা মানুষ অল্প পরিমাণে মাদক নিলে পায়। টিভি এবং ফেইসবুক দুটোই মানুষের মস্তিষ্কে সেই একই কেমিক্যাল ‘ডোপামিন’ নিঃসরণ করে, যা কোকেইন (মাদক) নিলে নিঃসরণ হয়। কিন্তু এই ডোপামিন হচ্ছে আসক্তির অন্যতম কারণ।[৪১১] যার কারণে যখন টিভি এবং ফেইসবুক বন্ধ হয়ে যায়, একধরনের বিষণ্ণতা, ক্লান্তি এসে ভর করে, যা কাটানোর জন্য আবার কখন টিভি এবং ফেইসবুকে যাবে, তার জন্য অস্থিরতা চলে আসে। এভাবে মানুষ এক ধরনের ‘উত্তেজনা-হতাশা-অস্থিরতা-উত্তেজনা’ চক্রে পড়ে যায়। এই চক্র থেকে সে আর সহজে বের হতে পারে না।
—এই অসুস্থ চক্র জীবনে অশান্তি নিয়ে আসে। মানুষকে নিরন্তর উত্তেজনার দাস বানিয়ে ফেলে। ঠিক এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে উত্তেজনা আসক্তির ফাঁদে ফেলার বাণিজ্যের উপর দাড়িয়ে আছে টিভি এবং ফেইসবুক। এই আসক্তিই তাদের ব্যবসা, তাদের আয়ের অন্যতম উৎস।
বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সফল মানুষদের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, তারা কেউ নিয়মিত টিভি এবং ফেইসবুক করেন না। তাদের এগুলোর ব্যবহার যোগাযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মাত্র ৯% ফেইসবুক ব্যবহারকারী যোগাযোগ করার জন্য ফেইসবুক ব্যবহার করেন। আর বাকি ৯১% ব্যবহারকারী ঘন ঘন উত্তেজনার ডোজ নেওয়ার জন্য নিয়মিত ফেইসুক ব্যবহার করেন। এরা একদিনও ফেইসবুক ভুলে থাকতে পারে না।
ফেইসবুকের যতই উপকারিতা থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো পুরো একটি প্রজন্মের চিন্তার গভীরতা নষ্ট করে দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা তৈরি করছে এটি। মাত্র কয়েক বছরে এটি কোটি মানুষের মধ্যে নারসিসিজম নামক একটি মানসিক ব্যাধির মহামারী ছড়িয়ে দিয়েছে, যা হচ্ছে অন্যের কাছে নিজেকে সুখী, সফল, গুণবান হিসেবে জাহির করে এক প্রতারণায় ভরা জীবন পার করার অন্ধ মোহ।[৪১২][৪১৩]
তোমার রবের পক্ষ থেকে পুরস্কার, এক যথার্থ উপহার
আমাদের কোনো বিশেষ অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী যখন নিজে আমাদেরকে পুরস্কার দেবেন বলে আমন্ত্রণ জানান, তখন আমাদের খুশি দেখে কে? আমাদের নিকট আত্মীয়রা গর্ব করে বলে বেড়ায়, “ওকে প্রধানমন্ত্রী নিজে পুরস্কার দেওয়ার জন্য ডেকেছেন! আমাদের চৌদ্দগুষ্টিতে কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পায়নি। কত বড় সম্মান আমাদের!” আর এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, মুত্তাকিরদের পুরস্কার আসবে তাঁর কাছ থেকে। কিয়ামতের দিন তাদেরকে তিনি تعالى নিজে সেই পুরস্কার দেবেন। বিশ্বজগতের প্রতিপালক নিজে এসে পুরস্কার দেওয়া কী বিরাট ব্যাপার হতে পারে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। কিয়ামতের দিন এই সৌভাগ্যবান মানুষগুলোর কোনো ভয় থাকবে না, যেদিন আমরা সবাই ভয়ে, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকবো। যেদিন আমরা দুনিয়ায় করা হাজারো ভুলের জন্য দুঃখে, আফসোসে মরে যেতে চাইবো, সেদিন এই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠদের আনন্দের কোনো সীমা থাকবে না। তারা থাকবেন আল্লাহর تعالى একান্ত সান্নিধ্যে, চিরসুখী।
তাঁর পক্ষ থেকে, যিনি আকাশগুলো এবং পৃথিবী সহ এদের মধ্যে যা কিছুই আছে, তার সবকিছুর প্রতিপালক; অত্যন্ত দয়ালু তিনি। কারো কোনো ক্ষমতাই থাকবে না তাঁর সামনে কিছু বলার। সেদিন রুহ এবং ফেরেশতারা সারি-সারি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। পরম দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন সে ছাড়া কেউ কোনো কথাই বলতে পারবে না এবং শুধুই সঠিক কথা বলবে।
এবার দৃশ্যপট ফিরে গেলো কিয়ামতের দিনে। এক ভিন্ন জগতে মানুষ আবার জন্ম নিয়েছে। দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল সমতল ভূমিতে। উপরে আকাশ এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত চিঁড়ে ফাকা করা। তার ভেতরে দিয়ে উপরের জগত থেকে অতি উন্নত সত্তারা উড়ে এসে সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বিরাট একটা কিছু ঘটানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এক সুশৃঙ্খল বাহিনী।
এরপর এক বিশাল আকৃতির একজনের আবির্ভাব হলো পুরো দিগন্ত জুড়ে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সেই অতিজাগতিক বাহিনীর প্রধান। তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। পুরো বাহিনী নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। সবাই অপেক্ষা করছে আকাশের উপরে অদৃশ্য যিনি আছেন, সেই সর্বপ্রধান, সর্বশক্তিমানের নির্দেশের। তাঁর নির্দেশ পাওয়া মাত্র শুরু হয়ে যাবে শেষ আদালত।
নিচে অজস্র মানুষ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন সেই আদালতে তার ডাক পড়বে।
“এগুলো সব গালগপ্প। কীভাবে মানুষ এই সব গাঁজাখুরি কাহিনী বিশ্বাস করে? মানুষ মরে মাটিতে মিশে যায়। তার দেহ পচে গলে পোকামাকড়, উদ্ভিদের খাবার হয়ে যায়। কীভাবে আবার সেই মানুষ হুবহু আরেকবার জন্ম নেওয়া সম্ভব? মানুষের প্রতিটি কথা নাকি রেকর্ড করা হচ্ছে? কোথায়? আশেপাশে কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। মানুষের হাত-পা নাকি সাক্ষী দেবে? হাত-পা আবার কথা বলতে পারে নাকি? এই সব বাচ্চাদের গল্প বড় মানুষরা বিশ্বাস করে কীভাবে?”
—কিছু মানুষের কাছে মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান, কিয়ামতের দিনের বিচার, জান্নাত-জাহান্নাম এসব হচ্ছে গালগপ্প, অশিক্ষিত মানুষের বিশ্বাস। অত্যাচারিত মানুষের জন্য ফালতু সান্ত্বনার কথা। দুনিয়াতে যারা কিছু পায় না, তাদের বুঝ দেওয়ার জন্য। এরা অবাক হয় যে, ধর্ম কোনো বুদ্ধিমান মানুষ বিশ্বাস করতে পারে নাকি? তাও আবার এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে?
এদের জন্য এই সুরাহ্’য় শেষ সাবধান বাণী—
সেদিনটি অনিবার্য। তাই যে চায়, সে তার রবের কাছে আশ্রয় খুঁজে নিক। আমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সাবধান করে দিলাম। যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি দেখবে সে কী করে এসেছে, আর অস্বীকারকারী বিলাপ করবে, “হায়, আমি যদি ধুলোয় মিশে যেতাম!”